টিকিটের টাকায় মেট্রোরেলের খরচ উঠতে লাগবে যত বছর

টিকিটের টাকায় মেট্রোরেলের খরচ উঠতে লাগবে যত বছর

২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর এবং ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। এটি মেট্রোরেল লাইন-৬ নামে পরিচিত। প্রথম পর্যায়ে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়। গত ৪ নভেম্বর চালু হয় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ। শুরুতে মতিঝিল পর্যন্ত এই মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়।

সম্প্রসারণসহ দুই দফায় সংশোধন করে এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। ১২ বছরের প্রকল্পটি ১৩ বছরে শেষ করা হচ্ছে। মেট্রোরেলের প্রধান আয়ের উৎস টিকিট বিক্রি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টিকিট বিক্রির টাকায় বিনিয়োগ উঠে আসতেই ৪৫ বছরের মতো সময় লাগবে। 

২০১২ সালে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্প পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষে হওয়ার কথা ছিল। পরে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রেলপথ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে প্রকল্পের সময় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। 

এ ছাড়া কয়েকটি স্টেশনের আশপাশে কিছু ভূমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এসব কারণে এই প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। খরচ বাড়ার হার ৫২ শতাংশ।

মেট্রোরেলের কারণে মানুষের যাতায়াত সহজ হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে আর যানজটে বসে থাকতে হচ্ছে না। যানজট নিরসনে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মেট্রোরেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বেশি।

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, পুরোদমে চালু হলে মেট্রোরেলে দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী চলাচল করবেন। তখন মাসে ৭২০-৭৩০ কোটি টাকা আয় হবে। সেই হিসাবে দাম না বাড়ালে শুধু টিকিট বিক্রির আয় দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ উঠে আসতে কমপক্ষে ৪৫ বছর লাগবে। 

এখন পর্যন্ত এটিই ঢাকার একমাত্র মেট্রোরেল। এর দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। স্টেশনসহ মোটাদাগে প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা বর্তমান বাজারদরে ( প্রতি ডলার ১১০ টাকা) ১৪ কোটি ডলারের বেশি। মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন অবশ্য প্রতি ডলারের দাম আরও কম ছিল। 

২০১৫ সালে ভারতে ভূ–উপরিস্থ (এলিভেটেড) মেট্রোরেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ২২১ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯২ কোটি টাকা) এবং ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৫৫২ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২৮ কোটি টাকা)। 

২০১৫ সালে চীনের ঋণে পাকিস্তানের লাহোরে ২৭ কিলোমিটার উড়াল (এলিভেটেড) রেলপথ তৈরিতে খরচ হয় ১৬৫ কোটি ডলার বা ১৮ হাজার কোটি টাকার কিছুটা বেশি। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ৬৭১ কোটি টাকা।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে পুত্রাজায়া পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। 

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ইউনানের ৩৪ কিলোমিটারের ভূ–উপরিস্থ এই মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। 

মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য পাঁচটি আলাদা চুক্তির মাধ্যমে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। গত বছরের মে মাসে মাশুল, সুদ, আসলসহ প্রথম কিস্তির ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় কিস্তির সুদ-আসল বাবদ ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর দুটি কিস্তিতে এভাবেই আগামী ৩০ বছর ঋণ পরিশোধ করতে হবে। 

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ঋণচুক্তির গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ নেওয়া ও পরিশোধ শুরুর মাঝখানের বিরতি) শেষ হবে আরও তিন বছর পরে। প্রথম ঋণচুক্তির কিস্তির মতো তখনো বছরে দুটি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। এভাবে ২০৩১-৩২ অর্থবছর থেকে পঞ্চম ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ওই বছর পাঁচটি ঋণচুক্তির জন্য একসঙ্গে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিস্তির পরিমাণও বাড়বে বলে জানা গেছে। ২০৬১-৬২ অর্থবছরে মেট্রোরেলের সব ঋণ পরিশোধ হবে। 

ডিএমটিসিএল সূত্রে আরও জানা গেছে, পুরোদমে চালু হলে মেট্রোরেলে দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী চলাচল করবেন। তখন মাসে ৭২০-৭৩০ কোটি টাকা আয় হবে। সেই হিসাবে দাম না বাড়ালে শুধু টিকিট বিক্রির আয় দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ উঠে আসতে কমপক্ষে ৪৫ বছর লাগবে। মেট্রোরেল যখন পুরোদমে চলবে, তখন প্রতিবছর গড়ে এক হাজার কোটি টাকার মতো পরিচালন ব্যয় হবে। এই খরচের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসবে টিকিট বিক্রি থেকে। বাকিটা পাওয়া যাবে স্টেশন প্লাজার দোকান ভাড়া, বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য খাত থেকে।

Share your comment :